বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ অপরাহ্ন
এমাজউদ্দীন আহমদ :
২৬ মার্চ এই জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই সূচনা হয় স্বাধীনতা অর্জন-উদ্যোগের মৃদু স্রোত। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় জীবনের বিস্তীর্ণ উপত্যকার হাজারো প্রান্তে অঝরে ঝরা অসংখ্য রক্ত স্রোতের সম্মিলিত প্রবাহে তা সমাজ জীবনের দুক‚ল ছাপিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হতে শুরু করে বেগবতী স্রোতস্বিনীর গতিতে, ১৬ ডিসেম্বর থেকে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তখন থেকে শুরু করে তার জয়যাত্রা। তখন থেকে শুরু হয় এই জাতির আশা-আকাক্সক্ষার নতুন প্রবাহ। সূচনা হয় রক্তরঞ্জিত পতাকাবাহী জনসমষ্টির বিশ্বজয়ী নতুন উদ্যোগ। সূচনা হয় বিশ্বের মানচিত্রে গর্বিত অবস্থান গ্রহণকারী বাংলাদেশের জনগণের সৃজনশীল কর্মের নতুন অধ্যায়।
এ দিনটিকে তাই এই জাতি স্মরণ করে আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীকরূপে। মনে রেখেছে হাজার বছরের ইতিহাসে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের দিগদর্শনরূপে। এই দিনে তাই কোনো অভিযোগ রাখতে নেই। নেইও কোনো অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে আজ। তথাপি বলতে হয়, যে প্রত্যক্ষ কারণে ২৬ মার্চের জন্ম অর্থাৎ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রায়কে যখন পাকিস্তানের বলদর্পী শাসকগোষ্ঠী দলিত মথিত করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টিকে স্বৈরাচারের শৃঙ্খলে স্থায়ীভাবে আবদ্ধ রাখার ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ করে, তারই তীব্র প্রতিবাদরূপে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। এই পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসুর ভিপি।
স্বাধীনতার ইস্তেহারও পাঠ করেন পল্টন ময়দানে আর একজন ছাত্র। তিনি শাজাহান সিরাজ। তারপর থেকেই এই দাবিতে ছাত্র-জনতা সম্মিলিত হতে থাকেন। তাদের সাথে একাট্টা হতে থাকেন কৃষক-শ্রমিকরা। হাত মেলান শিক্ষক-বিভিন্ন পেশায় কর্মরত প্রশিক্ষিত পেশাজীবীরা, সংস্কৃতিসেবী, এমন কি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও। এক কথায়, জাতীয় জনসমাজ বলতে যা বোঝায় সেই জাতীয় জনসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয় স্বাধীনতার দাবিতে। ২৫ মার্চের রাত্রিতে যখন পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয় নিরস্ত্র নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে, তাদের রক্ত ঝরাতে, সেই রক্তের প্রবাহ থেকেই জন্ম লাভ করে ২৬ মার্চ। সেদিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণের যুদ্ধ। প্রকৃত অর্থেই এক জনযুদ্ধ। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা দাবি তখন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এক-দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। দলীয় কর্মসূচি রূপান্তরিত হয়েছে এই ভূখন্ডের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবিতে।
তাই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধারা দলীয় আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ কোনো দলের কর্মীর মধ্যে সীমিত থাকেননি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে, জাতীয় স্বার্থকে ধারণ করে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে আগ্রসর হয়েছিল জাতীয় জীবনের সেই সংকটময় মুহূর্তে। সবাই দাঁড়িয়েছেন এক পঙ্ক্তিতে। দাঁড়িয়ে ছিলেন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্র অনুধাবন করে সেই ষড়যন্ত্রের শতগ্রন্থি ছিন্ন করতে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে। এই প্রেক্ষাপটেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের জন্য তখন পাকিস্তান ও ভারতের নেতৃবৃন্দ কী ভাবছিলেন, যুদ্ধের পরে তারা কী পেতে চেয়েছিলেন তাও জানা প্রয়োজন। জানা প্রয়োজন দুই পরাশক্তির সেই বিশ্বের পরাশক্তিসহ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাও। এই ক্ষুদ্র পরিসরে ভারতের নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য কী ছিল, যুদ্ধের পরে তারা কী পেতে চেয়েছিলেন তার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।
ভারতীয় নেতৃবৃন্দের লক্ষ্যের কথা বলছি সর্বাগ্রে এ জন্যে যে, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের কালে ভারত এগিয়ে এসেছিল। সবার আগে। পূর্ববাংলা থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রায় কোটিখানেক মানুষ ভারতেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাও পেয়েছিলেন আশ্রয়, অস্ত্র এবং অস্ত্র পরিচালনা ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযুদ্ধ অল্প সময়ে লাভ করে তার সফল ও যৌক্তিক পরিণতি। স্বাধীন বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দান করে ভারতই। এসব কারণে বাংলাদেশের জনগণ সব সময় গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে ভারতের সহযোগিতাকে স্মরণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জয়যাত্রা শুরু করার সময় বাংলাদেশ তাই ভারতকে কামনা করেছে সব সময় এক মহান প্রতিবেশী হিসেবে। কারণ বাংলাদেশের জন্মক্ষণে ভারত ও পূর্ববাংলার জনসমষ্টির একাংশের রক্ত এই মাটিতে মিশে গিয়ে দুই রাষ্ট্রের সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ভিত্তিকে শুধু সুদৃঢ় করেনি, করেছে ঘনিষ্ঠতম এবং পরম পবিত্র। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ এখনো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এই আলোকেই দেখে থাকেন।
ভারতীয় নেতৃবৃন্দের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশ কিন্তু কোনো সময় তেমন মর্যাদার আসন লাভ করেনি। ভারত এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে কেন জানি আজও বিদ্যমান রয়েছে এক ধরনের ভালোবাসা ও ঘৃণার (Love and hatred) আবহ, একরকমের আস্থা ও সন্দেহের (Confidence and doubt) ভাব। এর মূল অনুসন্ধান করতে অগ্রসর হোন, দেখবেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই এর কিছুটা লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়েছে। কালে তা হ্রাস পায়নি, বরং বেড়েছে। ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) গৃহীত হয়।
১৭ এপ্রিল সংগঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (Government of Bangladesh-in-exile)। এই তিন সপ্তাহের অধিক সময়কালে ভারত সরকার ভেবেছে, গভীরভাবে। হিসাব করেছে নিখুঁতভাবে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণে লাভ ও লোকসান সম্পর্কে। যেসব তথ্য আমরা পেয়েছি তা থেকে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চিহ্নিত করেছিলেন “এক কৌশলগত অসঙ্গতি” (A strategic irrelevance) রূপে। নেহেরু-গান্ধী এক জাতিতত্তে¡র ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে। শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাকে ত্রিভঙ্গ মুরারী করে তুলবে না তো! ভারতের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের একেবারে কাছেই ভারতের নেতৃত্বের দ্বিমুখিতা, দ্বিধা এবং সংশয় সম্পর্কে এনায়েতুর রহিম ও জয়েস এল. রহিম “US president Richard Nixon, Indian Prime Minister Indira Gandhi and Bangladesh War of Independence” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন : “পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়া ভারত ইউনিয়নের খন্ডছিন্ন হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে : না তো! (“Breaking up of Pakistan could trigger Balkanization of the Indian Union.”)। তারা লিখেন, শুধু তাই নয়, “সেই সাথে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামপন্থিদের প্রভাবকে করবে আকাশচুম্বী এবং তাও বাংলাদেশের অতিপ্রগতিশীল আন্দোলনের সহায়তায়” (“It will result in strengthening the hold of left politics in West Bengal assisted by the radicalism of the Bangladesh Movement”)।
তাই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় নেতৃত্ব দেখেছেন গভীর সন্দেহের চোখে। অগ্রসর হয়েছে অতি ধীর পদক্ষেপে, অত্যন্ত সচেতনভাবে, ধীরে-সুস্থে-ভেবে-চিন্তে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাক্রমে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ২৭ মার্চে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় এক বক্তৃতায় বলেন : “এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা ভীষণভাবে সচেতন। এর সমাধান ক্ষেত্রে কোনো ভ্রান্ত পদক্ষেপ, কোনো ভুল বক্তব্য যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায় সে সম্পর্কেও আমরা ভীষণভাবে সচেতন।” ৩১ মার্চে Indian Institute of Defence Studies and Analysis–এর পরিচালক কে সুব্রাহমানিয়াম (K. Subrahmanyam) বলেছিলেন : “ভারতকে এই সত্য অনুধাবন করতে হবে যে, পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করাই আমাদের স্বার্থের অনুকূল এবং এমন সুযোগ এরপর আর কখনো আসবে না।” [“What India must realise is the fact that break-up of Pakistan is in our interest, an opportunity the like of which will never come again,”]। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে Bangladesh and India’s National Security : The Options of India শিরোনামে লিখিত এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করে লিখেন যে, “মুক্ত বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কোনো বামপন্থি বিপ্লবী সরকার যেন সেখানে অধিষ্ঠিত হতে না পারে তেমন সামরিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে” [By such pre-emptory military moves, India could ensure her security by preventing a radically oriented leadership from being installed in power in Bangladesh.”]| ”]।
সুতরাং দেখা যায়, অত্যন্ত সচেতন বিচার-বিশ্লেষণের পরেই ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহায়তার হাত প্রসারিত করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মতে, রাজনৈতিকভাবে না হলেও অন্তত অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের সাথে ‘একীভূত’ (Integrated) হবে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে দুই দেশের মধ্যে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল তা পুনর্বহাল করা হবে। ভারতের অর্থনীতির সম্পূরক হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাসকে ভারতের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির (World view)ি সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করা হবে। অন্য কথায়, বাংলাদেশের বাজার হবে ভারতের দখলিকৃত এক বাজার (a captive market)। বাংলাদেশের নীতি ও কর্মসূচি হবে ভারতমুখী বা ভারতপন্থি (Pro-Indian)। বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ভারত। ফলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আর প্রয়োজন হবে না।
পাকিস্তানের দুর্বৃত্ত শাসকরা অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে শুধু চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে।
পূর্ব পাকিস্তানের মাটিকে। মাটির উপরে এবং নিচে যে সম্পদরাজি রয়েছে তাই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের লক্ষ্য। পাকিস্তানের রক্তপিপাসু জেনারেল টিক্কা খানের সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যকে স্মরণ করুন- “আমাকে ৭২ ঘণ্টা সময় দেয়া হোক, আমি সন্ত্রাসীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) নির্মূল করে পূর্ব পাকিস্তান ফিরিয়ে দেব” অথবা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নিজের হাতে লিখিত নির্দেশনামার- “পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ চত্বরকে লাল রক্তে রঞ্জিত করে দিতে হবে” (“The green of East Pakistan will have to painted red.”) দিকে দৃষ্টি দিন, অনুধাবনে এতটুকু অসুবিধা হবে না যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধ। সহায়তাদানকারী ভারতের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করা বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে, মুক্তিযোদ্ধাদের (যারা তাদের ভাষায় ছিল নিছক সন্ত্রাসকারী) নির্মূল করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি বন্দী ভূখন্ডে (A captive territory) রূপান্তরিত করে স্থায়ীভাবে এখানকার জনসমষ্টিকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা।
এই চরম সংকটকালে এই জনপদের, জনসমষ্টি কিন্তু হতোদ্যম হননি। তাদের এই সংগ্রামকে কে সমর্থন করবে এবং কে করবে না, তাও তাদের মনে আসেনি। কোন পরাশক্তি তাদের পক্ষে এবং কোন কোন বৃহৎ শক্তি তাদের বিপক্ষে তা পূর্ববাংলার জনগণ তখন চিন্তায় আনেনি। তখনও বিশ্বব্যাংক ছিল। ছিল আইএমএফ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা মুক্তিযুদ্ধকে কোন আলোকে গ্রহণ করবে তাও এ দেশের জনসমষ্টিকে দ্বিধান্বিত করেনি। পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে অসম যুদ্ধে রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে পূর্ববাংলার জনগণ যখন একটু একটু করে বিজয়ের দিকে এগোচ্ছিল তখন বিশ্বের জনমতের নৈতিক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেন। সেই পর্যায়েও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধারবৃন্দ বাংলাদেশের পক্ষে তেমন কথা বলেননি। বলেছেন অনেক পরে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঢাকা সফরে এসে ২০ মার্চে বললেন : “ঊনত্রিশ বছর আগে এই মাসে অসাধারণ প্রতিবন্ধকতার মুখে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এক নিঃসঙ্গ অভিযান শুরু করেছিল বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অনেক দেশের নিকট থেকে তখন তার প্রাপ্য সমর্থন লাভ করেনি।” [“Twenty nine years ago this month, against extraordinary obstacles Bangladesh began a lonely fight for existence that did not receive the support it deserved form many countries around the world”.]। সেই নিঃসঙ্গ অভিযানে বাংলাদেশের জনগণ মৃত্যুর মুখ থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন। সক্ষম হন একটি মাত্র কারণে এবং তা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে তারা সম্মিলিত হয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক শিক্ষাটি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ কী ভুলে গেছেন? এটাই তো বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক শক্তি। অন্তত আজকের দিনে, ২৬ মার্চে, জাতীয় নেতৃত্ব কী ভাববেন এ বিষয়ে? জাতিসংঘ অথবা বিশ্বব্যাংক অথবা তথাকথিত দাতাগোষ্ঠীর বিষয়ে ভাববার আগে ৩৪ বছর আগের এই দিনটির মর্মকথা কী অনুধাবন করবেন একবার? সংঘাত নয়, সংহতি যে এর মূল সুর তা কী একবার অনুভব করবেন? বিভেদ নয়, ঐক্যবোধই যে এর মূল ছন্দ তা কেন আসে না স্মরণে? জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদার ভিত্তি হলো জাতীয় ঐক্য। জাতির উজ্জ্বল ভাবমূর্তির জন্য অপরিহার্য ওই একটিই এবং তা হলো জাতীয় ঐক্য। ২৬ মার্চের মূল কথাও তাই। এদিকে জাতীয় নেতৃত্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হোক- এই কামনা করে ২৬ মার্চের স্থপতিদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
C: Inqilab